আধুনিক বিশ্বে জ্ঞান চর্চায় আল-গাজ্জালী (রহ.)

2513

মূল: ইবরাহিম কালিন
অনুবাদ: মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান

কুরআন এবং সুন্নাহর বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক জগতে নিজের সমগ্র জীবন অতিবাহিত করেছেন আল-গাজ্জালী (রহ.)। কঠোর সাধনায় জ্ঞানের জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং সঠিক জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও নৈতিকতার চূড়ায় পৌছানোর জন্য একনিষ্ঠ সাধনায় মগ্ন থেকেছেন।

বর্তমান সময়ে জ্ঞানকে (Knowledge) প্রায়ই তথ্যের (Information) সাথে মিলিয়ে ফেলা হয় এবং মানুষ জ্ঞানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য খুব সহজেই ভুলে যায়। তাই জ্ঞান অর্জনের জন্য বিষয়বস্তুর মূলে পৌছানো খুবই জরুরী। সেক্ষেত্রে, আধুনিক বিশ্বে সঠিক জ্ঞান চর্চায় প্রসিদ্ধ মুসলিম মনীষীদের মধ্যে আল-গাজ্জালী (রহ.) অন্যতম।

আল-গাজ্জালী (রহ.) তার সমসাময়িক অন্যান্য মনীষীদের মধ্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, তিনি এমন একজন চিন্তাবিদ যিনি কোন একটি বিষয়কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করতে পারতেন। আদি বিজ্ঞান, ধর্মীয় আইন, ধর্মতত্ত্ব, দর্শন আর অধিবিদ্যার বিভিন্ন শাখাতে তার পদচারণা তাকে অন্য সকলের থেকে আলাদা করেছে। তিনি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আল মুনকিয মিন দালাল’ এ একজন নিবেদিতপ্রাণ জ্ঞান সাধক হিসেবে তার পথচলার গল্প বলেছেন এবং অন্যান্য জ্ঞানানুসন্ধানীরা যেন পথ ভুল না করে সেজন্য এ পথের বাধা-প্রতিবন্ধকতাগুলোও বর্ণনা করেছেন।

কুরআন-সুন্নাহর বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যত্মিক জগতে তার পদচারনা এবং জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে একীভূত করার দক্ষতা শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত যোগ্যতারই সাক্ষ্য দেয় না বরং তার সময়কার বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক পরিবেশের প্রমান বহন করে। যে পরিবেশে তিনি একজন চিন্তাবিদ এবং পন্ডিত ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে বিকশিত করেছিলেন। তিনি এমন এক সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষিত পরিবেশে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন যেখানে জ্ঞানকে সর্বোৎকৃষ্ট গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হত আর জ্ঞানী মানুষদের আসন ছিল অনেক উপরে। কুরআন জ্ঞানের ধারক ও বাহক হওয়ার কারণেই তাদেরকে এই মর্যাদা ছিল।

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে জ্ঞান (ইল্‌ম) এবং এর সমার্থক শব্দগুলো ৭৫০ বারেরও বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত ওহী, নবী-রাসূলদের জীবনী, মানবিক ধারণাসমূহ অথবা প্রাকৃতিক বিশ্বের অনেক কিছুই জ্ঞানের নির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই জ্ঞান বৃহৎ কিছুকে নির্দেশ করে এবং সাধারণ তত্ত্বের তুলনায় বহুগুণ বিশেষায়িত হয়। এটা একপ্রকার পথনির্দেশ (আয়াত), যার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কেবল বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষেরাই উৎঘাটন করতে পারে। এটা শুধুমাত্র ব্যক্তির উপলব্ধিকেই প্রশস্ত করে না বরং পৃথিবীর সকল মানবের মাঝে নৈতিক দায়িত্ববোধ এবং আধ্যত্মিক চেতনা জাগ্রত করে। সত্যিকারের জ্ঞান বিশ্বাস নৈতিকতার দিকে ধাবিত করে কারণ সকল জ্ঞান প্রকৃতপক্ষে সামগ্রিক বিষয়বস্তুর উৎসের নির্দেশক।

কোন কিছুর উৎস সম্পর্কে না জানা থাকলে একজন ব্যক্তি কখনো সত্য এবং সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে পারে না। যেমন বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটলের কথা অনুযায়ী কোন কিছুর কারণ জানা ছাড়া এর প্রভাব ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। যেহেতু স্রষ্ঠা সকল ঘটনার পেছনের কারণ এবং সকল পরিণতির উৎস সেহেতু সকল সত্য জ্ঞান স্রষ্ঠা হিসেবে তাঁর সম্পর্কিত জ্ঞানের সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িত। ঠিক এই কারণেই কুরআন জ্ঞান, বিশ্বাস এবং নৈতিকতার সাথে একটি দৃঢ় বন্ধন স্থাপন করেছে।

এইভাবে চিন্তা করলে জ্ঞান মানসিক চিন্তার বহি:প্রকাশ হতে পারে না। এটা শুধুমাত্র সাক্ষরতাও না আবার বিশ্ব প্রকৃতিকে পরিচালনার কোন কার্যপদ্ধতিও নয়। বরং, সত্যিকার জ্ঞান হচ্ছে কোন কিছুর অস্তিত্ব বা উৎসের সাথে নিজেকে যুক্ত করার এবং অস্থিত্বের রূপান্তরের প্রক্রিয়া। এটা ব্যক্তিকে পরিবর্তন করে এবং সাথে সাথে তাকে বিজ্ঞ করে তোলে। গভীরভাবে চিন্তা করলে এটা ব্যক্তিগত, কারণ জ্ঞানের পরিবর্তনশীলতার সাথে ব্যক্তির পরিবর্তন হবে না এটা হতে পারে না। সত্যিকার জ্ঞান আমাদেরকে শুধু প্রজ্ঞাই দান করে না বরং আমাদেরকে নৈতিকতা এবং আধ্যত্মিকতার সন্তোষময় জীবনের দিকে ধাবিত করে।

আল-গাজ্জালি (রহ.) এরূপ জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও নৈতিকতার অপূর্ব সমন্বয়ের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। তার বিভিন্ন অবদান যেমন, “ইহইয়া উলুম আদ-দ্বীন”, “আল মুস্তাফা”, “আল-ইকতিসাদ ফিল-ইতিক্বাদ”, “মিশকাত আল-আনওয়ার” এবং “তাহাফাত আল-ফালাসিফাহ” এ তিনি ঐশীবাণী এবং যৌক্তিক জ্ঞানের অপরিহার্য সমন্বয় দেখিয়েছেন। যেহেতু সত্যিকার জ্ঞান আমাদেরকে কোন বিষয়ের অস্তিত্বকেই প্রকাশ করে, তাই সেটা আমাদেরকে সেই জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করার দিকেও আহবান জানায়। বিষয়টা ঠিক এমন যে, একজন মাঝি যে কিনা সমুদ্র এবং বাতাসের গতি সম্পর্কিত সকল জ্ঞান রাখে, এটা তার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু তাকে সেই জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করতে হবে অন্যথায় সমুদ্র ঝড়ের সামনে সে দাঁড় বইতে বা অস্থিত্ব রক্ষা করতে পারবে না। শুধুমাত্র জানাই যথেষ্ট হতে পারে না বরং প্রজ্ঞাসম্পন্নও হতে হবে। অর্থাৎ সঠিক ও বেঠিকের মধ্যে পার্থক্য করা জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

আল-গাজ্জালি (রহ.) এই বিষয়টার উপর এতই দৃঢ় ছিলেন যে, তিনি যুক্তিবিদ্যার উপর তার অন্যতম প্রধান কাজ “মি’য়ার আল ইলম” এর সূচনাতে সত্য জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং নৈতিকতা অর্জনের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমান সময় ব্যয় করেছিলেন। তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন মানবজাতিকে যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি (আক্‌ল) দান করার জন্য যার মাধ্যমে তারা সত্য এবং মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করতে পারে। তিনি অজ্ঞতা এবং অনুমাননির্ভর জ্ঞানকে তিরস্কার করেছেন। তিনি তার পাঠকদেরকে ভিত্তিহীন সন্দেহ থেকে সাবধান করেছেন। প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। আল-গাজ্জালি (রহ.) সত্য জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা অর্জনের চাবিকাঠি হিসেবে যুক্তি/বুদ্ধিবৃত্তির ভূয়াসী প্রশংসা করেছেন। কিন্তু মানবজাতির প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত রহমত হিসেবে যুক্তির প্রশংসা করলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি যুক্তিবাদী নন। প্রকৃতপক্ষে, আল-গাজ্জালী (রহ.) যুক্তিকে বিষয়বস্তুর বিশাল পরিসরে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে ব্যবহার করেছেন মাত্র।

সত্য জ্ঞানার্জন খুব কঠিন একটা কাজ এবং এর জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক দৃঢ়তা প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তি তথ্য থেকে জ্ঞান, জ্ঞান থেকে প্রজ্ঞা, প্রজ্ঞা থেকে নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জগতে পদার্পন করে। কম্পিউটারের পর্দায় তথ্য পড়ে থাকার এই দুনিয়ায় এ বিষয়টা মনে রাখা খুবই প্রয়োজন যে, সেটা যত রঙিন আর যথাযথই হোক না কেন আপনাকে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও নৈতিকতা প্রদান করতে পারবে না। একজন ব্যক্তিকে এই জ্ঞান অর্জনের প্রকৃত পথ ও পন্থা জানতে হবে।

(তুরস্কের বিখ্যাত পত্রিকা ‘ডেইলি সাবাহ’র কলাম অবলম্বনে অনূদিত)
মূল লেখা: https://goo.gl/M4dVSD
ইবরাহিম কালিন সম্পর্কে জানতে : http://www.ibrahimkalin.com/test/ibrahim-kalin/